বাঁশিওয়ালা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
‘ওগো বাঁশিওয়ালা,
বাজাও তোমার বাঁশি,
শুনি আমার নূতন নাম;---
এই ব’লে তোমাকে প্রথম চিঠি লিখেছি,
মনে আছে তো?।
আমি তোমার বাংলাদেশের মেয়ে।
সৃষ্টিকর্তা পুরো সময় দেন নি
আমাকে মানুষ ক;রে গড়তে,
রেখেছেন আধাআধি করে।
অন্তরে বাহিরে মিল হয় নি--
সেকালে আর আজকের কালে,
মিল হয়নি ব্যথায় আর বুদ্ধিতে,
মিল হয়নি শক্তিতে আর ইচ্ছায়।
আমাকে তুলে দেন নি এ যুগের পারানি নৌকায়--
চলা আটক করে ফেলে রেখেছেন
কালস্রোতের ও পারে বালুডাঙায়।
সেখান থেকে দেখি
প্রখর আলোয় ঝাপসা দূরের জগৎ;
বিনা কারনে কাংগাল মন অধীর হয়ে ওঠে;
দুই হাত বাড়িয়ে দেই,
নাগাল পাই নে কিছুই কোনো দিকে।।
বেলা তো কাটে না,
বসে থাকি জোয়ার-জলের দিকে চেয়ে---
ভেসে যায় মুক্তিপারের খেয়া,
ভেসে যায় ধনপতির ডিঙা,
ভেসে যায় চলতি বেলার আলোছায়া।
এমন সময় বাজে তোমার বাঁশি
ভরা জীবনের সুরে,
মরা দিনের নাড়ীর মধ্য
দব্দবিয়ে ফিরে আসে প্রাণের বেগ।।
কী বাজাও তুমি,
জানি নে সে সুর কার মনে জাগায় কী ব্যথা।
বুঝি বাজাও পঞ্চম রাগে
দক্ষিন হাওয়ার নব যৌবনের ভাটিয়ারি।
শুনতে শুনতে নিজেকে মনে হয়
যে ছিল পাহাড়তলির ঝির্ঝিরে নদি
তার বুকে হঠাৎ উঠেছে ঘনিয়ে
শ্রাবনের বাদল-রাত্রি।
সকালে উঠে দেখা যায় পাড়ি গেছে ভেসে,
একগুঁয়ে পাথরগুলিকে ঠেলা দিচ্ছে
অসহ্য স্রোতের ঘূর্ণিমাতন।।
আমার রক্তে নিয়ে আসে তোমার সুর
ঝড়ের ডাক, বন্যার ডাক,
আগুনের ডাক,
পাঁজরের-উপরে-আছাড়-খাওয়া
মরন সাগরের ডাক,
ঘরের-শিকল-নাড়া উদাসী হাওয়ার ডাক।
যেন হাঁক দিয়ে আসে
অপূর্নের সংকীর্ন খাতে
পূর্ন স্রোতের ডাকাতি--
ছিনিয়ে নেবে ভাসিয়ে দেবে বুঝি।
অঙে অঙে পাক দিয়ে উঠে
কালবৈশাখির-ঘূর্ণি-মার -খাওয়া অরণ্যের বকুনি।।
ডানা দেননি বিধাতা--
তোমার গান দিয়েছে আমার স্বপ্নে
ঝোড়ো আকাশে উড়োপ্রানের পাগলামি।।
ঘরের কাজ করি শান্ত হয়ে;
সবাই বলে ‘ভালো’
তারা দেখে আমার ইচ্ছের নেই জোর,
সাড়া নেই লোভের,
ঝাপট লাগে মাথার উপর
ধুলোয় লুটাই মাথা।
দুরন্ত ঠেলায় নিষেধের পাহারা কাত ক’রে ফেলি
নেই এমন বুকের পাটা;
কঠিন করে জানিনে ভালবাসতে,
কাঁদতে শুধু জানি,
জানি এলিয়ে পড়তে পায়ে।।
বাঁশিওয়ালা,
বেজে ওঠে তোমার বাঁশি,
ডাক পড়ে অমর্তলোকে;
সেখানে আপন গরিমায়
উপরে উঠেছে আমার মাথা।
সেখানে কুয়াশার পর্দা-ছেঁড়া
তরুন সূর্য আমার জীবন।
সেখানে আগুনের ডানা মেলে দেয়
আমার বারন-না-মানা আগ্রহ,
উড়ে চলে অজানা শূন্যপথে
প্রথম-ক্ষুধায়-অস্থির গরুরের মতো।
জেগে উঠে বিদ্রোহিণী,
তীক্ষন চোখের আড়ে জানায় ঘৃনা
চারদিকের ভীরুর ভিড়কে--
কৃশ কুটিলের কাপুরুষতাকে।।
বাঁশিওয়ালা,
হয়তো আমাকে দেখতে চেয়েছ তুমি।
জানি নে, ঠিক জায়গাটি কোথায়,
ঠিক সময় কখন,
চিনবে কেমন ক’রে।
দোসরহারা আষাঢ়ের ঝিল্লিঝনক রাত্রে
সেই নারীতো ছায়া রূপে
গেছে তোমার অভিসারে
চোখ- এড়ানো পথে।
সেই অজানাকে কত বসন্তে
পরিয়েছ ছন্দের মালা--
শুকোবে না তার ফুল।
তোমার ডাক শুনে একদিন
ঘরপোষা নীর্জীব মেয়ে
অন্ধকার কোন থেকে
বেরিয়ে-এল ঘোমটা খসা নারী।
যেন সে নতুন ছন্দ বাল্মীকির,
চমক লাগাল তোমাকেই।
সে নামবে না গানের আসর থেকে;
সে লিখবে তোমাকে চিঠি
রাগিনীর আবছায়ায় বসে--
তুমি জানবে না তার ঠিকানা।
ওগো বাঁশিওয়ালা।
সে থাক তোমার বাঁশির সুরের দূরত্বে।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন